“বাংলাদেশ’-এর শ্রীহট্ট জেলার কুশীয়ারা নদীর তীরে ধীরশ্রী গ্রাম। সেই গ্রামের জমিদার, দত্তচৌধুরী পরিবারে গুরুসদয় দত্ত জন্মগ্রহণ করেন ১২৮৯ বঙ্গাব্দের ২৮শে বৈশাখ (১৮৮২ খৃষ্টাব্দের ১০ই মে)। পিতা রামকৃষ্ণ দত্ত এবং মাতা আনন্দময়ী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র। জন্মলগ্নে কুলগুরু বাড়িতে উপস্থিত থাকায় নাম হল “গুরুসদয়”। সবার আদরের ‘সদয়’।
বালক ‘সদয়’কে প্রায়ই দেখা যেত কুশীয়ারা নদীর তীরে, হাওরের “গো” চারণ ভূমিতে অথবা নদীর বুকে কলার ভেলায় বা নৌকাতে। এর মধ্যেই প্রকাশ পেত বালকের দুরন্তপনা, সাহসিকতা ও দৃঢ়তা। কখনও দেখা যেত পাহাড়ী ঘোড়ার পিঠে। কখনও দিতেন দলীয় নেতৃত্ব। এই ভাবে গড়ে উঠেছে শিশু মন থেকে কৈশোর। মাতার কাছে পেয়েছেন ধর্মানুরাগ। পিতার কাছে পান সর্বধর্ম সমন্বয়ের মন্ত্র। ছোট থেকেই তাঁর মধ্যে দেখা যায় স্বাজাত্যবোধ। পড়াশোনায় ছিলেন মনোযোগী, উৎসাহী এবং জ্ঞানপিপাসু। কোন কাজে অকৃতকার্য হ’লে পুনঃ পুনঃ চেষ্টায় কৃতকার্য হওয়ার মধ্যে তাঁর জেদী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।
পিতামাতার স্নেহের সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছিলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রীতারকনাথ রায়ের অফুরন্ত স্নেহ-ভালবাসা এবং আশীর্বাদ। বিদ্যালয়ে সমস্ত পরীক্ষাতে হতেন প্রথম। মাত্র ১৪ বৎসর বয়সে পিতামাতাকে হারান। ১৮৯৮ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। দ্বিতীয় স্থান লাভ করার অতৃপ্ততা তাঁকে ১৯০১ সালে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হিসাবে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হবার প্রেরণা যোগায়। ঐ সময় তদানীন কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি কংগ্রেস ভলান্টিয়ারদের ইনচার্জ হন। শ্রীহট্ট সম্মিলনীর সহায়তায় ১৯০৩ সালে বিলাত যান এবং একই সাথে আই.সি.এস. ও ব্যারিস্টারী পড়া শুরু করেন। উভয় পরীক্ষাতেই ১৯০৫ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। আই. সি. এস. পরীক্ষায় ‘ঘোড়ায় চড়া বিষয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে ১০০ নম্বর পান। এই বৎসরের শেষে দেশে ফিরে আসেন এবং বিহারের আরা জেলায় মহকুমা শাসকের পদে নিযুক্ত হন। বিলাতে যাওয়ার অপরাধে প্রায়শ্চিত্তের পরিবর্তে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
১৯০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আই. সি. এস. শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ দে-র চতুর্থ কন্যা সরোজনলিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। সরোজনলিনী দেবী কোনো বিদ্যালয়ে না গিয়েও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। ঘোড়ায় চড়া, টেনিস খেলা, বেহালা বাজানো, গান গাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর দখল ছিল পূর্ণমাত্রায়। স্বদেশী গান গাইতে তিনি বেশী ভালবাসতেন।
১৯০৯ সালে একমাত্র পুত্র বীরেন্দ্রসদয় দত্তের জন্ম হয়। গুরুসদয় দত্ত অন্য সাহসী শিকারী ছিলেন। কখনও পূর্ণিয়ার জঙ্গলে কখনও সুন্দরবনে তাঁকে শিবান করতে দেখা যেত – সঙ্গে থাকতেন সরোজনলিনী দেবী।
১৯১১ সালে সরোজনলিনী দেবীর অনুপ্রেরণায় বিচার বিভাগে কাজ নিজে বিহার থেকে বাংলায় চলে আসেন। ১৯১২ সাল থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি অবিভক্ত বাংলার বহু জেলায় যথা – খুলনা, যশোহর, ফরিদপুর, কুমিল্লা, ঢাকা বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে বিচার বিভাগে কাজ করেন। ১৯১৭ সালে বীরভূম জেলার কালেক্টর হন। বীরভূম জেলার সমস্ত রকম উন্নয়ন মূলক কাজে ছিল তাঁর সমান আগ্রহ। তাই অচিরেই তিনি সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। ১৯১৯ সালে তিনি স্ত্রী পুত্র নিয়ে জাপানে যান। সেখানকার বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কার্য পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯২০ সালে জাপান থেকে ফেরেন এবং ১৯২১ সালে বাঁকুড়া জেলার জেলা শাসক নিযুক্ত হন। ১৯২২ সালে তিনি ঐ জেলায় সমবায় প্রথায় চাষের কাজের প্রকল্প করেন। সরোজনলিনী দেবী সব সময় ব্যস্ত থাকতেন বিভিন্ন মহিলা সমিতি গঠন করে দুঃস্থ নারীদের কল্যাণমূলক কাজে।
গুরুসদয় দত্ত বাঁকুড়া জেলায় এক স্বদেশী মেলারও প্রচলন করেন। এই সময় বাঁকুড়ার স্বদেশী আন্দোলনকারীদের নানাভাবে সাহায্য করতেন। ১৯২৩ সালে শাসন বিভাগ থেকে বদলী হয়ে কৃষি ও শিল্প বিভাগের সচিব-এর কার্যভার গ্রহণ করেন। ১৯২৫ সালের ১৯শে জানুয়ারী সরোজনলিনী দেবী দেহত্যাগ করেন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এবং দুঃস্থ মহিলাদের কল্যাণে স্ত্রীর শ্রদ্ধ বাসরে ২৩শে ফেব্রুয়ারী “সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতি” প্রতিষ্ঠা করেন। স্ত্রী বিয়োগে তিনি কিছুটা ভেঙ্গে পড়েন। কারণ সরোজনলিনী দেবী ছিলেন তাঁর সমস্ত কাজের প্রেরণা। ১৯২৬ সালে তিনি আবার শাসন বিভাগে ফিরে আসেন এবং হাওড়া জেলার জেলাশাসক নিযুক্ত হন। গ্রাম উন্নয়নের জন্য হাওড়ায় ‘গ্রামের ডাক” নামক পত্রিকার প্রচলন করেন এবং “হাওড়া জেলা কৃষি ও হিতকারী সমিতি” প্রতিষ্ঠা করেন।
ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য পুকুর, খাল কাটান, জঙ্গল পানা নির্বাসনের জন্য সকলকে উৎসাহিত করেন। ১৯২৮ সালে লিলুয়া রেলওয়ে ওয়ার্কসপের শ্রমিকদের উপর বামনগাছিতে বিনা প্ররোচনায় ইংরাজ সরকারের মিলিটারী ও পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর ইংরাজ সরকার বিরোধী ঐতিহাসিক রায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টকেও কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যার জন্যে তিনি ইংরাজ সরকারের কু-নজরে পড়েন। কোন আই. সি. এস. কে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা যায় না। তাই তাঁকে হাওড়া থেকে বদলী করা হয়। ১৯২৯ সালের রোমের আন্তর্জাতিক কৃষি সম্মেলনে যোগ দিয়ে ফিরে এসে মৈমনসিংহ জেলার জেলা শাসকের কার্যভার গ্রহণ করেন। ঐ বৎসর চতুর্থবার লণ্ডন যান। সেখানে ইংলণ্ড লোকনৃত্য ও লোকগীতি রক্ষা সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এলবার্ট হলের এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
লোকসংস্কৃতি রক্ষার প্রেরণা আগেই পেয়েছিলেন। এবার তা প্রকট হল। জেলা শাসকের দায়িত্ব নেওয়ার পর মৈমনসিংহ জেলায় প্রতিষ্ঠা করেন “মৈমনসিংহ লোকনৃত্য ও লোকগীতি সমিতি”। এই সময়ে চলছিল গান্ধীজীর নেতৃত্বে লবণ আইন আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের প্রতি লাঠি-গুলি চালনা না করার ফলে গুরুসদয় দত্তকে টেলিগ্রাম যোগে আরো ছোট জেলা বীরভূমে বদলী করা হল। মাত্র পাঁচ মাসের মতো তিনি মৈমনসিংহের জেলাশাসক ছিলেন।
গুরুসদয় দত্তকে পুনরায় বীরভূমে ফিরে পেয়ে বীরভূমবাসী আনন্দিত। তিনি বীরভূমে গঠন করেন “লিজ ক্লাব এ্যামেচার মিউজিক্যাল সোসাইটি”। জেলার অন্যান্য উন্নয়ন মূলক কাজের ফাঁকে খোঁজ করতে শুরু করলেন লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতি। রচনা করলেন বহু গান। ১৯৩০ সালে তিনি বীরভূমের লুপ্তপ্রায় রায়বেশে নৃত্যের পুনরাবিষ্কার করেন। ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন “বঙ্গীয় পল্লী সম্পদ রক্ষা সমিতি”। এই সমিতির কাজে ছিল লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতির পুনরুদ্ধার করা। এই সমিতির সংগ্রহ ভাণ্ডারে জমা হয় লোকনৃত্য, লোকগীতি ও লোকশিল্পের বহু নমুনা।
বঙ্গীয় পল্লী সম্পদ রক্ষা সমিতি আয়োজিত (সিউড়ীতে) এক লোকনৃত্য শিক্ষাশিবিরে ১৯৩২-এর ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ২৩শে মাঘ) ‘ব্রতচারী’ প্রবর্তনের কথা ঘোষণা করেন। এই বীরভূমেই তিনি আবিষ্কার করেন শ্রীনবনীধর বন্ধ্যোপাধ্যায়কে, যিনি পরবর্তীকালে ব্রতচারী জগতে “নায়ক আলা” নামে পরিচিত হন। ১৯৩৩ সালে কেন্দ্রীয় বিধানসভার সদস্য থাকাকালীন দিল্লীতে সর্বভারতীয় লোকনৃত্য ও লোকগীতি সমিতি গঠন করেন। ১৯৩৪ সালে ‘বঙ্গীয় পল্লী সম্পদ রক্ষা সমিতি’র নাম পরিবর্তন করে সরকারী নথিভুক্ত করেন “বাংলার ব্রতচারী সমিতি”। নামে। ১৯৩৫-এ লণ্ডনে আন্তর্জাতিক লোকনৃত্য উৎসবে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি রূপে একমাত্র ভারতীয় হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে গুরুজীর নেতৃত্বে হায়দ্রাবাদের নিজাম প্যালেসে এবং শরৎ বসুর বাড়িতে গান্ধীজী ও সুভাষ বসুর সামনে ব্রতচারীরা এক অভিপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে কলিকাতার নিকটে ঠাকুরপুকুরের জোকা অঞ্চলে ১০১ বিঘা জমি নিয়ে ব্রতচারী গ্রামের পত্তন করেন।
১৯৪১ সালের ২৫শে জুন দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। তিনি ‘ভজার বাঁশী’, ‘চাঁদের বুড়ী’, ‘পাগলামীর পুঁথি’, ‘গ্রামের ডাকের ক-খ-গ’, ‘ব্রতচারী সখা’, ‘ব্রতচারী পরিচয়’, ‘পটুয়া সঙ্গীত’, ‘বাংলার বীর যোদ্ধা রায়বেশে”, ব্রতাচারী সিন্থেসিস’, ‘ফোক্ ডানসেস অব বেঙ্গল’ নামক গ্রন্থসমূহ রচনা করেন। সংগ্রহ করেন প্রায় আড়াই হাজার লোকশিল্পের দুর্মূল্য নমুনা। সমস্ত দিয়ে যান বাংলার ব্রতচারী সমিতিকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।